অজ্ঞাত নম্বর থেকে তাঁর মুঠোফোনে এক তরুণীর কল আসে। এরপর থেকে নিয়মিত
কথা হতে থাকে দুজনের। একসময় দেখা হয়, ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। দুজন একসঙ্গে ঘোরাঘুরি
করেন। একসঙ্গে বসবাস করেন ২১ দিন। একদিন গভীর রাতে নির্জন স্থানে
ছুরিকাঘাত করে ওই তরুণীকে হত্যা করেন তিনি। দেড় বছর আগে ঘটনাটি ঘটে রংপুরের
কাউনিয়া উপজেলায়।
ক্লুবিহীন এই হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না। আনুমানিক
২৫ বছর বয়সী ওই তরুণী ওই এলাকার না, শুধু এটুকুই নিশ্চিত হতে পেরেছিল
পুলিশ। অজ্ঞাতনামা লাশ হিসেবেই তাঁকে দাফন করা হয়। মেয়েটির খোঁজ নিতেও কেউ
কোনো দিন আসেনি পুলিশের কাছে। এ অবস্থায় মেয়েটিকে কেন হত্যা করা হয়েছে, কার
সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় ছিল এমন কোনো তথ্য পাচ্ছিল না পুলিশ। তবে দেড় বছর পর
সেই হত্যা রহস্য উন্মোচন হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ।
পুলিশের ভাষ্য,
হত্যার অভিযোগে কছিম উদ্দিন (৪৫) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কছিম উদ্দিনের স্বীকারোক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে হত্যার কারণ। ওই ব্যক্তি
জানিয়েছে, বেশ কয়েক দিন একত্রে বসবাসের পর তিনি ওই তরুণীর কাছ থেকে সটকে
পড়তে চাইছিলেন। কিন্তু ওই তরুণী কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না। তাই ‘আপদ’ বিদায়
করতে হত্যা করেন।
দুই বছর পর হত্যা রহস্য উন্মোচন হলেও হতভাগ্য সেই
তরুণীর পরিচয় এখনো জানতে পারেনি পুলিশ। ওই ব্যক্তিও মেয়েটির নাম ‘রোজিনা’
ছাড়া তেমন কোনো তথ্য জানেন না। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ‘সম্পর্ক’ রাখবেন
চিন্তা করে পরিচয় কখনো জানার চেষ্টাও করেননি।
যেভাবে হত্যারহস্য উদ্ঘাটন
কাউনিয়া উপজেলার কুর্শা
ইউনিয়নের কুর্শা গ্রামের কুর্শা বিলের ধানখেতে ২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর এক
তরুণীর গলা ও পেটে-বুকে ছুরিকাঘাত করা লাশ পড়ে থাকতে দেখে এলাকার লোকজন
থানার পুলিশকে খবর দেয়। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কাউনিয়া থানার উপপরিদর্শক
(এসআই) শাহাদাত হোসেন ২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা
করেন। তখন মামলাটি তদন্ত করেন থানার এসআই হিল্লোল রায়। কিন্তু সাত মাসেও
তিনি হত্যারহস্য ও খুনিকে শনাক্ত করতে না পেরে মামলাটি হস্তান্তর করেন
রংপুর সিআইডি পুলিশকে। সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক এ কে এম নাজমুল কাদের
মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান।
হত্যাকাণ্ডের শিকার তরুণীর পরিচয় উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। হত্যার
অভিযোগে গ্রেপ্তার কছিম উদ্দিনের বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কাউনিয়া
থানার বাগবাড়ি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মৃত জফুর উদ্দিন। গ্রামের বাড়িতে
কছিম উদ্দিনের স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে থাকে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রংপুর সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক এ কে এম নাজমুল
কাদের বলেন, এটি ছিল ‘ক্লুলেস মার্ডার’। ঘটনার কোনো সাক্ষী বা
প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। কছিম উদ্দিন একাই এই হত্যা করেছেন বলে দাবি করেছেন।
হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল মেয়েটি
এই এলাকার নয়। তাই ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকার কারা রংপুরের বাইরে কাজ করেন,
তাঁদের নাম-ঠিকানা প্রথমে সংগ্রহ করা হয়। এরপর তাঁরা বাড়িতে আসামাত্র
গ্রাম পুলিশ ও এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে ক্রমান্বয়ে
তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। একপর্যায়ে এক ব্যক্তি তথ্য দেন কছিম
উদ্দিন নামে একজনের সঙ্গে একদিন অপরিচিত এক নারীকে এলাকায় তিনি দেখেছিলেন।
পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও কছিম উদ্দিনের সঠিক অবস্থান নিশ্চিত হওয়া
যাচ্ছিল না। এ কারণে তাঁর গ্রামে আসার অপেক্ষায় থাকে পুলিশ। ১৩ মে রোববার
গ্রামে এলে কছিম উদ্দিকে আটক করে সিআইডি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকার করেন তিনি একাই ওই তরুণীকে হত্যা করেন।
কেন এই হত্যা?
সিআইডির কর্মকর্তা নাজমুল কাদের
বলেন, ধরা পড়ার পর বিস্ময় প্রকাশ করে কছিম উদ্দিন বলেন, ‘স্যার, ওরে আমি
হত্যা করছি একাই। এটা জানে শুধু আল্লাহ, আমি আর অয় (নারী)। আপনি তা জানলেন
কেমন করে!’
গত মঙ্গলবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে কছিম উদ্দিন বলেন, মুন্সিগঞ্জে
একটি বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ট্রাক চালানোর সময় রোজিনা নামে পরিচয় দিয়ে
এক নারী হঠাৎ তাঁকে মুঠোফোনে ফোন দেন (রং নম্বর)। এরপর ওই নারীর সঙ্গে
তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। ওই নারীর প্রকৃত পরিচয়
তিনি জানতেন না। তবে তাঁর বাড়ি ঢাকার আশুলিয়ার জিরানী বাজারে বলে তিনি
তাঁকে (কছিমকে) জানান। তখন কছিম উদ্দিন থাকতেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ
আর্ট স্কুল মোড়ের একটি ভাড়া বাসায়। একদিন ওই নারী তাঁর ওই বাসায় আসেন। এ
সময় তাঁরা বাসার অন্য লোকজনদের স্বামী-স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। সেখানে ১৫ দিন
থাকার পর কছিম উদ্দিন ওই নারীকে নিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরের তাঁর এক
ভগ্নিপতির বাসায় ওঠেন। সেখানে পাঁচ দিন অবস্থান করে ওই নারীকে নিয়ে কছিম
উদ্দিন বাসে করে রংপুরে চলে আসেন। এরপর তিনি পীরগাছা উপজেলার সাতভিটা
গ্রামে তাঁর এক খালার বাসায় ওই নারীকে নিয়ে ওঠেন। সেখান থেকে ২০১৬ সালের ২
নভেম্বর তিনি তাঁর খালাতো এক ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে বিয়ের দাওয়াত খেতে যান।
ওই দিন সন্ধ্যার পর ওই নারীকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে কছিম
উদ্দিন হেঁটে রওনা দেন। এরপর রাত আনুমানিক দুইটার দিকে কৌশলে ওই নারীকে ওই
বিলের মাঝখানে নিয়ে কোমর থেকে ছুরি বের করে গলার মাঝবরাবর আঘাত করেন। সঙ্গে
সঙ্গে মেয়েটি মাটিতে ঢলে পড়েন। এরপর পরনের ওড়না দিয়ে নাকমুখ চেপে তাঁকে
হত্যা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও তিনি ওই নারীর বুকের ডান দিকে
একাধিকবার ছুরি দিয়ে আঘাত করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা এ কে এম নাজমুল কাদের বলেন, কছিম উদ্দিন ছুরিটি রংপুরের
মডার্ন মোড়ের একটি দোকান থেকে কিনেছিলেন। ঢাকার আশুলিয়ার জিরানীর বাজারসহ
আশপাশের থানায় এবং নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে রোজিনার পরিচয় জানতে
খোঁজ করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর পরিবারের কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
নাজমুল
কাদের বলেন, ‘ওই তরুণীর পরিচয় উদ্ঘাটনে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিকবার
বেতারবার্তা পাঠিয়েছি। এখনো ওই নারীর পরিচয় পেতে চেষ্টা করছি।’
No comments:
Post a Comment